
নতুন শহরে যাচ্ছি৷
দীর্ঘ ট্রেন যাত্রা৷
সন্ধ্যায় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে আমার ট্রেন তার যাত্রা শুরু করে৷ জানালার পাশের সিটই নিয়েছি আমি৷ একমনে চেয়ে আছি আকাশের পানে৷ আকাশে আজ মস্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে৷ পূর্ণিমার চাঁদ৷ নিঃসঙ্গতার জীবনে চাঁদই আমার একমাত্র সঙ্গী৷ আমার সাথে সাথে চাঁদও ছুটে চলেছে৷ আমার তো নির্ধারিত গন্তব্য আছে৷ চাঁদের কোনো গন্তব্য নাই৷ নির্ধারিত নাই কোনো আপনজন তার৷
পাশের সিটটিতে একের পর এক মানুষ উঠছে পরবর্তী স্টেশনে নেমে যাচ্ছে৷ স্থায়ী কেউ হচ্ছে না৷ আমিই হয়তো দীর্ঘ পথের যাত্রী, যার স্থায়ীত্ব শুরু থেকে শেষ অবধি৷
পাশের সিটে একজন মাঝ বয়সী লোক উঠেছিলো এক পর্যায়ে৷ শুরু থেকেই সে ফোনে এতটা তীব্রভাবে কথা বলে চলেছেন যে আমি পাশে বসে আমার প্রিয়তমা চাঁদের সাথে নিজের মনোযোগ ধরে রাখতেই পারছি না৷ আকর্ষণ বিচ্ছিন্ন হওয়াতে চাঁদও অভিমান করে মেঘের চাঁদরে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে৷ পরের স্টেশনে তিনি নেমে গেলে পরবর্তী দু ষ্টেশনে পাশের আসনটি ফাঁকাই ছিলো৷
ট্রেনের জানালাটা হালকা খোলা রেখেছি৷ শীতল বাতাস আমাকে সাময়িক সুখ দিলেও চোখখানা খুঁজে চলেছিলো মেঘের আড়ালে থাকা চাঁদকে৷ পোড়াদহ স্টেশনে ট্রেন একটু লম্বা বিরতি দিলেও যাত্রী তেমন ওঠেনি৷ সচরাচর ট্রেনগুলোতে যাত্রীর এমন ভাঁটি লক্ষ্য করিনি পূর্বে৷ ট্রেন পুনরায় যাত্রা শুরু করতেই আচমকা এক সদ্য যৌবনে পদার্পন করা এক তরুণীর কণ্ঠ ভেসে আসলো৷
❝এখানে কেউ আছে?❞ সে যে প্রশ্নটি আমাকে লক্ষ্য করেই করেছে এই উপলব্ধিটি আমার হয়নি৷ আমি তো চাঁদকেই খুঁজে চলেছি৷ প্রশ্নটি দ্বিতীয়বার করায় আমার হুস ফেরে৷ বাস্তবে ফিরে আসি আমি৷ মেয়েটির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিছুক্ষন পর্যবেক্ষন করলাম৷ মেয়েটি হাঁপাচ্ছে৷ হয়তো ট্রেন মিস হয়ে যাওয়ার জন্যই রিস্ক নিয়ে দৌড়ে ট্রেনে উঠেছে৷ আমি তার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে তার দিকে এগিয়ে দেই৷ তিনি পুনরায় আমাকে প্রশ্ন করেন, ❝ আপনি কথা বলতে পারেন না❞৷ আমি এবার মৌনতা ভেঙে বলি, হ্যাঁ পারি তো৷ শুরু করলে শেষই হতে চায় না৷ মেয়েটি মুচকি হেসে পানির বোতলটি নিয়ে পানি খাওয়া শুরু করলো৷ ধন্যবাদ দিয়ে বোতলটি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমার পাশের সিটে বসে পড়লো৷ আমি মনে মনে ভাবলাম মেয়েটি দারুন তেজী৷ হয়তো কোনো রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে হবে৷ নতুবা এই রাতের যাত্রায় একাকী যেতো না৷ সাহস পায়ের নখ থেকে চুলের আগা অবধি৷ ভয়ে ভয়ে আমি চুপচাপ আমার ওই চাঁদ খোঁজার কাজে মনোযোগ দিলাম৷ মেয়েটি আবার প্রশ্ন করে কোথায় যাচ্ছেন? আমি জানাই, একবারে শেষ গন্তব্যে৷ আপনি?
মেয়েটি আবারও হাসি দিলো৷ তবে তার এই মুচকি হাসি আমাকে আকৃ্ষ্ট করেনি বিন্দুমাত্র৷ তিনি জানান তিনিও যাচ্ছেন। মানে আমার তিনজনের গন্তব্যই শেষ ষ্টেশন৷ তিনজন বলতে আমরা দুজন আর ট্রেন৷ খুঁজলে হয়তো সংখ্যাটা আরো দীর্ঘ হবে৷ অযথা সুন্দরী তরুণী পাশে রেখে অহেতুক কাজে সময় নষ্ট করার স্বাদ আর জাগেনি৷ দীর্ঘক্ষন চুপচাপ থেকে আমিই মেয়েটির সাথে কথা বললাম৷ দুবার তো তিনিই শুরু করেছেন৷ আমি যদি একবার না শুরু করি, ব্যাপারটা বেয়াদবি হয় নাকি এই ভাবনা থেকেই আমি কথা বলি৷ কিন্তু কি বলে শুরু করবো বুঝতে না পেরে বলেই ফেললাম, আকাশে দারুন চাঁদ উঠেছে৷ আপনি কি দেখবেন? আপনি চাইলে আমার এখানে বসতে পারেন৷ আমার একটু বেশি বাইরে যেতে হয় তো৷ মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞাস করে আপনার ডায়বেটিস নাকি? এবার আমি না হেসে পারলাম না৷ লাজুক একটা হাসি দিয়ে বললাম না, ডায়বেটিস না৷ আসলে সিগারেটটা একটু বেশি খাইতো৷ একটু পর পর বাইরে যেতে হয়৷ ট্রেনে ধূমপান নিষিদ্ধ, তাই টয়লেটে গিয়ে খেয়ে আসি৷ মেয়েটি ছি বলে কেমন ন্যাকামো একটা ভাব করলো যেনো আমি সিগারেট না, টয়লেটে গিয়ে গু খেয়ে আসি৷ এরপর দুজনেই চুপচাপ৷ আমি আবার বললাম মেয়েটিকে, আসবেন কি এই পাশে? মেয়েটি জানালো, আচ্ছা আসেন৷ এরপর মেয়েটি জানালার ধারে সিটে বসে আকাশের পানে অনেকক্ষন চেয়ে রইলো৷ ভাবলাম মেয়েটিও হয়তো আমার মতো চন্দ্র প্রেমিক৷ ওহ মেয়েরা তো প্রেমিক হয় না৷ হয় প্রেমিকা৷ আমার একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিলো৷ চোখটা লেগে এসেছে৷ এমন সময় মেয়েটার ধমক সুরে কথা শুনে তন্দ্রা কেটে গেলো৷ রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞাস করে চাঁদ কোথায়? আমি জানাই, চাঁদ আমার উপর অভিমান করে মুখ লুকিয়েছে৷ আপনাকে পাঠালাম, যদি আপনাকে দেখা দেয় একটুখানি৷ মেয়েটি এবার অট্টহাসি দিয়ে উঠলো৷ আমি আর কথা বাড়ালাম না৷ চুপচাপ টয়লেটে গেলাম সিগারেট ধরাতে৷ পর পর তিনটি সিগারেট ধরালাম৷ আধ ঘন্টা পর সিটে ফিরে দেখি মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে৷
এই যে আমাদের মধ্যে এতক্ষন কথোপকথন হলো, আমি সেই উনি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই একবার তার দিকে তাকিয়েছিলাম৷ এরপর আর তাকাই নি৷ এবার আমার সিট থেকেই তাকে অতিক্রম করে চাঁদ উঠেছে কিনা দেখতেই আবিষ্কার করলাম তাকে ঘুমন্ত অবস্থায়৷ এবার কেনো জানি আমার চোখ সড়ছেই না৷ ট্রেনের সব আলো নিভিয়ে দেয়া৷ সব যাত্রী মধ্য ঘুমে আচ্ছন্ন৷ হয়তো ঘুমিয়ে গেছে পুরো পৃথিবী৷ জেগে আছি আমি আর চাঁদ শুধু৷ চাঁদ যেনো তার আলোয় মেয়েটিকে স্নান করিয়ে দিয়েছে৷ সদ্য বিবাহিত মেয়ে বাসর রাতের পরদিন ভোরে স্নান সেরে গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে যখন ঘরে প্রবেশ করে, ঠিক তেমনই লাগছে৷ মৃদ্যু শরৎ বাতাস তার চুলগুলোকে আন্দোলিত করে চলেছে৷ তবে একগুচ্ছ বজ্জাত কেশমালা তার কপাল থেকে নাকের বাম পাশ হয়ে যা ঠোঁটে মিশেছে, তা সরছেই না বাতাসে৷ একবার ইচ্ছা হলো আমি সড়িয়ে দেই৷ সাহস হলো না আর৷
ছাত্রজীবনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র রাজনীতি করেছিলাম৷ দলের দূর্দিনেও আপাদমস্তক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছি৷ কিন্তু আজ অসহায়৷ বাস্তব এই যে পুরুষ মাত্রই নারীর নিকট অসহায়৷ ভিতু৷ সাহসহীন৷ শুষ্ক ঠোঁট যেনো ডিঙি নৌকার প্রতিকী রুপ৷ বাঁকে ঠোঁটে চাঁদের কিরণ লেগে ফুটে উঠেছে এক মোহময় হাসি৷ হঠাৎ তার কপালের কালো ছোট্টো টিপে আমার নজর আটকে যায়৷ অতীতগুলো জ্বলন্ত হতে থাকে আমার সম্মুখে৷
ছাত্রজীবনে কোনো এক হেমন্তের রজনীতে ট্রেন যাত্রায় আমার পাশে ছিলো আমার খুব কাছের এক মানুষ৷ ট্রেনে যাত্রা শুরুর কিছুক্ষন পরেই সে ঘুমিয়ে যায়৷ তার দ্রুত ঘুমানোরও কিছু যথেষ্ট কারন আছে৷ গত তিনদিন আমরা প্রচুর ঘোড়াঘুড়ি, দৌড়াদৌড়িতে ছিলাম৷ ক্লান্ত সে৷ ঘুম হয়নি ঠিকঠাক৷ আর আমার তো ঘুমের সাথে বিচ্ছেদ, মনোমালিন্য বহুকাল ধরেই৷ সেদিন হয়তো আজকের মতো পূর্ণিমা ছিলো৷ কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা ছিলো চাঁদ৷ তাই অনুমান করতে পারিনি তার পক্ষকালকে৷ সব আলো নিভানো থাকলেও পাশের সিটে থাকা ফিক্সড লাইট, যেটা নেভানো যায় না, সেটি জ্বলছিলো৷ জানালার পাশে তীব্র ঘুমে আচ্ছাদিত সে৷ তার ঘুমে যেনো আলো ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্য আমি বহুবার চেষ্টা করেছিলাম আলোটি বন্ধ করার৷ ট্রেনের কেবিনবয়কেও ডেকে পাঠালাম৷ পরে নিশ্চিত হলাম এ আলো নেভে না৷ আমার বসার ধরন কয়েকবার পরিবর্তন করে চেষ্টা করলাম আলোর তীব্রতা কমাতে৷ জানিনা কতটুকু পেরেছিলাম৷ সেবারই শেষবার কোনো মেয়ের দিকে দীর্ঘঘন তাকিয়ে ছিলাম৷ ঘুমন্ত মেয়ের নিষ্পাপ মুখখানা যেকোনো পুরুষের শত কষ্টকে লাঘব করবে৷
❝মামা চা খাবেন❞ শব্দটি শুনেই আচমকা হুস ফেরে আমার৷ এটাকে শুধু তিন শব্দের শব্দ বা বাক্য বলে সীমাবদ্ধ করা যাবে না৷ রীতিমতো হুঙ্কার৷ হুঙ্কার বলছি এই কারনে যে তার ওই শব্দে সেই তরুণীর ঘুমও ভেঙে যায় আর চোখে চোখ পরে৷ আমি তো ইতস্ততবোধ করছিলাম৷ না জানি এভাবে তাকিয়ে থাকাকে সে কিভাবে নেবে৷ তিনি কিছু বলার আগেই আমি তাকে বলি চা খাবেন? তিনি হ্যাঁ সূচক জবাব দেন৷ এরপর চাওয়ালা মামাকে বলি দুইটা লাল চা দিতে৷ তরুণী জানালো তিনি লাল চা খান না৷ তার এই জবাবে আমার পুনরায় অতীতে ডুব দিতে ইচ্ছা করলো, কারন সেই মেয়েটি যে আমার খুব কাছের একজন, সেও বারংবার দুধ চা খেতে পছন্দ করতো৷ তবে এবার আমি অতীতে ডুব দিয়ে ভোরের এই স্নিগ্ধ আবহাওয়া হাতছাড়া করিনি৷ সিটের সামনে রেখে দেয়া পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে জানালা দিয়েই ফ্রেশ হয়ে নিলো মেয়েটি৷ এরপর দুজনে চা খেলাম৷ বাক্যালাপহীন এক চা আড্ডা বলা যায় এই সময়টিকে৷ কিছুক্ষন পরেই আমাদের গন্তব্য চলে আসে৷ ট্রেনের শেষ গন্তব্য যেথায়৷ আমার জিনিসপত্র বেশি থাকায় সবকিছু নামাতে একটু সময় লাগলো৷
তরুণীটি বিদায় বেলাতে বলে গেলো, ❝ সুরঞ্জন সাহেব চুপচাপ থেকে শুধু ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকলেই হবে৷ মুখখানা দিয়ে যদি কথাই না বের হয় অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলবেন৷ ❞ আমি তার প্রস্থানপানে চেয়ে রইলাম৷ আশ্চর্য, মেয়েটি আমার নাম জানলো কিভাবে?
এরপর আমি বহু জায়গায় মেয়েটিকে খুঁজেছি। ট্রেনের ❝জ❞ বগীতে দুটি সিট কেটে যাত্রা করেছি তার অপেক্ষায়৷ আমার নাম কিভাবে জানলো সেই প্রশ্ন করতে নয়৷ তাকে শুধু তার প্রশ্নের জবাবে এতটুকুই বলতে চাই, ❝চোখ যেথায় মনের কথা বলে সেখানে মুখের ব্যাবহার নিরর্থক ৷ সেই কথা যার বোধগম্য নয়, তার স্থায়িত্বের চেয়ে প্রস্থানটাই আমার কাছে শ্রেয়৷ ❞